IQNA

ফারুক ওয়াসিফের এ প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা :

"পানি নামার পথে উন্নয়নের যত বাধা।"

22:01 - June 22, 2022
সংবাদ: 3472028
তেহরান (ইকনা): আমি ৪ বছর আগে ' পলাশী দিবস ' প্রবন্ধে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসন কর্তৃক বাংলার বন্যা সমস্যার উদ্ভব এবং নদী শাসন ও পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনার ধ্বংস সাধন সম্পর্কে লিখেছিলাম :

"" শুধু তাই নয় বাংলা নদীমাতৃক কৃষিপ্রধান দেশ। পানি এবং নদনদী , খাল-বিল , পুকুর , হাওর , জলাশয় প্রভৃতি বাংলার জনজীবন ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে অপরিসীম গুরুত্বের অধিকারী। এক কথায় বাংলার মতো দেশগুলোর ক্ষেত্রে পানি সম্পদের চৌকষ দক্ষ শাসন ও সুব্যবস্থাপনার সাক্ষর ও নিদর্শন স্বরূপ। মধ্যযুগে ( ১২০০- ১৭৫৭ ) মুসলিম শাসক ও প্রশাসকদের তত্ত্বাবধানে প্রাচীন ওভারফ্লোসেচ ব্যবস্থা ( Overflow Irrigation System) উন্নত ও সংস্কার করে ট্যাংক সেচ ব্যবস্থায় ( Tank Irrigation System) রূপান্তরিত করা হয়। এ সময় নদনদীর তীর বাঁধাই ও বেড়ি বাঁধ নির্মাণ করে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি নিষ্কাশনের সুযোগ-সুবিধা সমূহের ( Drainage facilities) উন্নয়ন শুরু হয় এবং তা ১৭৫৭ সালে মুসলিম ( মুঘল - নবাবী ) শাসনের শেষ পর্যন্ত চলতে থাকে । উত্তম সেচ , পানি নিষ্কাশন এবং নৌচলাচল নিশ্চিত করার জন্য মুঘল শাসকরা পূর্ববর্তী সেচ ব্যবস্থা সমূহকে বহাল রেখে দীর্ঘ নদী পথ জুড়ে ( অর্থাৎ নদীর পাশাপাশি এবং নিকটে ) বাড়তি খাল খনন এবং নদীতীর বাঁধাই ও বেড়ি বাঁধ নির্মাণের ( বাঁধ দিয়ে পরিবেষ্টন বা সংরক্ষণ ) ধারণা প্রবর্তন করেন। মুঘলরা নদ-নদী ড্রেজিং করার বিষয়টিও সংযোজন ( প্রবর্তন ) করেন ( Ali , 2002)।

বাংলার প্রাদেশিক মুঘল প্রশাসন নদীতীর বাঁধাই , বেড়িবাঁধ , সড়ক , রাস্তা-ঘাট , পুল এবং নদ-নদী ড্রেজিং , তত্ত্বাবধান ও দেখভাল করার জন্য পুলবন্দী দফতর ( Pulbandi Daftar/دَفْتَرِ  پُلْبَنْدِی ) নামে স্বতন্ত্র একটি প্রশাসনিক অফিস ও বিভাগ পরিচালনা করতেন । কিন্তু ১৭৫৭ সালে বাংলায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্য ও শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে নয়া প্রশাসন অর্থাৎ ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ এই পুলবন্দী দফতর বিলুপ্ত করে দেয় যা বাংলার জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় বয়ে এনেছিল। তখন থেকে অর্থাৎ ১৭৫৭ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১৯০ বছর জনস্বার্থ বিরোধী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশবাদী সরকার কর্তৃক বাংলার পানি সম্পদ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হয় এবং সরকারের পানি ব্যবস্থাপনা ও নীতি না থাকার কারণে বাংলায় মুহুর্মুহু বন্যা ও শস্যহানি হতে থাকে ।  ( বিস্তারিত জানার জন্য পড়ুন : AHM Kausher প্রণীত Water Resources Management in Bangladesh : Past , Present & Future - এ প্রবন্ধটি , Email: engineerkausher@yahoo.com )

     প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে, ব্রিটিশ শাসনামলে সময়মত নদ-নদী সংস্কার ও ড্রেজিং এবং নদীর তীর বাঁধাই এবং বেড়িবাঁধ কার্যক্রম চালু না থাকার কারণে নদ-নদী ভরাট হয়ে বন্যা ও নদী ভাঙ্গন ইত্যাদির প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। আজ বাংলাদেশে নদ-নদী ভরাট হয়ে যাওয়া বা সেগুলো হেজেমজে যাওয়ার সমস্যা তথা ভয়াবহ বন্যা সমস্যা ইত্যাদি হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে দুষ্টু সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ কুশাসন ও শোষণের রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার। ""

-----------

রমেশচন্দ্র মজুমদার বাংলাদেশের ইতিহাস গ্রন্থে ( আধুনিক যুগ , পৃ : ৫৬৭ ) লিখেছেন: " আলোচ্য যুগে ( বিংশ শতাব্দীর শুরু ১৯০৫ থেকে ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভাগ পর্যন্ত ) কৃষিজাত দ্রব্যের উৎপাদন অনেক হ্রাস পাইয়া ছিল । জঙ্গল পরিষ্কার করা এবং রেল লাইন বিস্তারের ফলে জল স্রোতের স্বাভাবিক গতিরোধ ইহার জন্য দায়ী।"

তাহলে স্পষ্ট হয়ে যায় অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট ও রেল লাইন নির্মাণ, পানি সম্পদ অব্যবস্থাপনা ,নদ - নদী সংস্কার ও ড্রেজিং না করার কারণে নদী ভরাট হয়ে বন্যা সমস্যা , নদী ভাঙ্গন , শস্যহানি , জলবদ্ধতা ইত্যাদি দুষ্টু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার যা থেকে এত পাশ্চাত্য শিক্ষিত প্রকৌশলী ও আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকা সত্ত্বেও আজও আমরা রেহাই পাচ্ছি না !!!! এর কারণ কী ? মুঘল প্রকৌশলী ও পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনার কর্মকর্তারা ছিলেন একাধারে যেমন নিজেদের কর্ম ও পেশায় দক্ষ ঠিক তেমনি বাংলার  ভৌগলিক পরিবেশ প্রকৃতি সম্বন্ধে ছিল তাদের সম্যক জ্ঞান ও পরিচিতি এবং নিষ্ঠা যা ব্রিটিশদের ছিল না এবং পরবর্তীতে পাশ্চাত্য শিক্ষিত দেশীয় প্রকৌশলী ও পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনার কর্মকর্তাদের মধ্যেও যার তীব্র অভাব  পরিলক্ষিত হচ্ছে । আর "পানি নামার পথে উন্নয়নের যত বাধা " -----  লেখক ফারূক ওয়াসিফের এ প্রবন্ধেও এ বিষয়টি প্রতিফলিত হয়েছে । বাংলাদেশে বন্যা আসলে ব্রিটিশ আমল থেকে অপরিকল্পিত সড়ক , রাস্তাঘাট ও রেল লাইন নির্মাণ এবং নদীনালা খালবিল , জলাশয় ও জলাভূমি সংস্কার না করার অমোঘ পরিণতি স্বরূপ। আর হাওর অঞ্চলের সাম্প্রতিক বন্যাও অত্র অঞ্চলে রাস্তা নির্মাণের ভুল কার্যক্রমের মাশুল স্বরূপ যা পানির স্বাভাবিক গতি ও প্রবাহে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী এবং বন্যা ও জল বদ্ধতার জন্য দায়ী ।

ইসলামী চিন্তাবিদ এবং গবেষক হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলেমিন মুহাম্মদ মুনীর হুসাইন খান

captcha