IQNA

আলেমরাই হচ্ছেন নবী-রাসুলদের উত্তরসূরি: আলহাদিস  

বিশ্বনবী (সা.) জগতসমূহের জন্য মহান আল্লাহর রহমত

8:52 - October 15, 2022
সংবাদ: 3472652
তেহরান (ইকনা): সবাইকে সালাম ও অজস্র শুভেচ্ছা জানিয়ে এবং মহানবী ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের শানে অজস্র দরুদ আর সালাম পাঠিয়ে শুরু করছি ঈদে মিলাদুন্নবী (সা) সংক্রান্ত আলোচনা। বিশ্ববাসীর জন্য মহান আল্লাহর সবচেয়ে বড় উপহার কি এ প্রশ্ন করা হলে যে উত্তর প্রত্যেক জ্ঞানী ও বিবেকবানের মুখে উচ্চারিত হবে তা হল বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা)'র পবিত্র অস্তিত্ব।
বিশ্বনবী (সা.) মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য সবচেয়ে বড় উপহার। তিনি হচ্ছেন মহান আল্লাহর অশেষ দয়া ও করুণা তথা রহমতের সর্বোচ্চ প্রকাশ। এ জন্যই পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয়তম হাবিব তথা মহানবী-সা.-কে জগতসমূহের জন্য রহমত বলে উল্লেখ করেছেন। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনকে মুমিনদের জন্য আল্লাহর রহমত তথা কেবল একটি রহমত বলে উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে মহানবীকে জগতসমূহের জন্য আল্লাহর রহমত বলে উল্লেখ করার মাধ্যমে তাঁকে মহান আল্লাহর আরও বড় রহমত বলে ঘোষণা করেছেন। তাই তাঁর জন্মদিনই বিশ্বের সবচেয়ে বড় আনন্দ বা উৎসবের দিন। মহান আল্লাহ এই মহামানবকে সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী বলেও পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করেছেন। তাঁকে সৃষ্টি না করলে আল্লাহ কিছুই সৃষ্টি করতেন না। অন্য কথায় মুদ্রার মধ্যে সুতার মত যে জিনিষটি থাকে তা না থাকলে মুদ্রার যেমন মূল্য থাকে না, তেমনি মহানবীকে সৃষ্টি না করলে মহান আল্লাহর অন্য সব সৃষ্টি হত মূল্যহীন। 
 
বিজ্ঞ আলেম সমাজ ও ঐতিহাসিকদের অনেকেই বিশেষ করে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অনুসারী মুসলিম চিন্তাবিদদের বেশিরভাগই মনে করেন মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) জন্ম নিয়েছিলেন রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখে এবং তাঁর ওফাত বা মৃত্যু-দিবসও একই দিনে। অন্যদিকে মহানবীর আহলে বাইতের অনুরাগী শিয়া মুসলিম সমাজের বেশিরভাগই মনে করেন বিশ্বনবী (সা) জন্ম নিয়েছিলেন ১৭ রবিউল আউয়াল এবং তিনি দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছিলেন সফর মাসের ২৮ তারিখে। মুসলমানদের এই দুই ধারার মধ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতি সৃষ্টির লক্ষ্যে ইরানের ইসলামী বিপ্লবের রূপকার মরহুম ইমাম খোমেনি ১২ থেকে ১৭ রবিউল আউয়ালকে ইসলামী ঐক্য সপ্তাহ হিসেবে ঘোষণা করেন। উল্লেখ্য, ১৭ রবিউল আউয়াল মহানবীর (সা) আহলে বাইতের পবিত্র সদস্য হযরত ইমাম জাফর সাদিক্ব (আ)'রও জন্মদিন। এ নিয়ে আমরা কথা বলব অন্য সময়ে।  
 
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) মানবতার মুক্তির দিশারী এবং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ ও পূর্ণ মানব। তিনি ছিলেন মানব জীবনের সব ক্ষেত্রের ও সব পর্যায়ের সর্বোত্তম এবং পূর্ণাঙ্গ আদর্শ। তাই তাঁর শুভ জন্মদিন মানব জাতির জন্য সবচেয়ে বড় আনন্দের দিন হওয়ার পাশাপাশি এই দিন মুসলমানদের মিলন ও ঐক্যেরও সবচেয়ে বড় শুভ-লগ্ন।   
 
বিশ্বনবী (সা.) ছিলেন মহামানবদেরও শিক্ষক এবং সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী ও মহান আল্লাহর সর্বশেষ অথচ সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল। তাঁর পর আর কোনো নবীর আবির্ভাব হবে না এ কারণেই যে মানব জাতির সর্বাঙ্গীন কল্যাণ ও সৌভাগ্যের জন্য যা যা দরকার তার সব নির্দেশনাই তিনি দিয়ে গেছেন এবং তাঁর নির্দেশনাগুলোর যুগোপযোগী ব্যাখ্যা দিয়ে গেছেন তাঁরই বংশে জন্ম নেয়া পবিত্র ইমামগণ।
 
মহানবীকে জানতে হলে আমাদেরকে ফিরতে হবে কুরআনের দিকেই। মহানবীর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন প্রত্যেক নবী। পবিত্র কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী মহানবীকে পাঠানো হয়েছে সমগ্র মানবজাতির জন্য। কুরআনে মহান আল্লাহ বলছেন: আমি আপনাকে পাঠিয়েছি মানুষের প্রতি আমার পয়গামের বাহক হিসাবে। আর সাক্ষী হিসেবে মহান আল্লাহই যথেষ্ট। সুরা তওবার ৩৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, তিনিই পাঠিয়েছেন আপন রাসূলকে হেদায়েত ও সত্যধর্ম সহকারে, যেন এ ধর্মকে অন্যান্য ধর্মের উপর জয়যুক্ত করেন, যদিও মুশরিকরা তা অপ্রীতিকর মনে করে। 
পবিত্র কুরআনের এসব বাক্য থেকে বোঝা যায় ইসলাম ধর্ম সর্বজনীন ও তা সব ধর্ম ও মতবাদের ওপর বিজয়ী হবে। আর এটাও স্পষ্ট যে মহানবীর রেসালাত ও নবুওয়ত কোনো স্থান বা অঞ্চল, বংশ, সময় ও ভাষা, বর্ণ আর গোত্রের গণ্ডীতে সীমিত নয়। 
 
মহানবী (সা)-কে গোটা মানবজাতির জন্য সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শনকারী ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে পাঠাইনি বলেও পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করেছেন মহান আল্লাহ।  
 
হযরত ইব্রাহিম ও হযরত ইসমাইল সর্বশেষ রাসুলের আগমনের জন্য দোয়া করেছিলেন। পবিত্র কুরআনের সুরা বাকারার ১২৯ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে: হে পরওয়ারদেগার! তাদের মধ্যে থেকেই তাদের কাছে একজন পয়গম্বর পাঠান যিনি তাদের কাছে তোমার আয়াতগুলো তিলাওয়াত করবেন, তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দিবেন এবং তাদের পবিত্র করবেন। নিশ্চয়ই তুমিই পরাক্রমশালী হিকমতওয়ালা।   
হযরত ঈসা (আ)ও বিশ্বনবীর আগমনের সুসংবাদ দিয়ে গেছেন। তাওরাত ও ইঞ্জিলেও দেয়া হয়েছিল মহানবীর আগমনের সুসংবাদ। সুরা আরাফের ১৫৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,  
 
সে সমস্ত লোক, যারা আনুগত্য অবলম্বন করে এ রসূলের, যিনি উম্মী নবী, যাঁর সম্পর্কে তারা নিজেদের কাছে রক্ষিত তওরাত ও ইঞ্জিলে লেখা দেখতে পায়, তিনি তাদেরকে নির্দেশ দেন সৎকর্মের, বারণ করেন অসৎকর্ম থেকে; তাদের জন্য যাবতীয় পবিত্র বস্তু হালাল ঘোষণা করেন ও নিষিদ্ধ করেন হারাম বস্তুগুলো এবং তাদের উপর থেকে সে বোঝা নামিয়ে দেন এবং বন্দীত্ব অপসারণ করেন যা তাদের উপর বিদ্যমান ছিল। তাই যেসব লোক তাঁর উপর ঈমান এনেছে, তাঁর সাহচর্য অবলম্বন করেছে, তাঁকে সাহায্য করেছে এবং সে নূরের অনুসরণ করেছে যা তার সাথে অবতীর্ণ করা হয়েছে, কেবল তারাই নিজ নিজ উদ্দেশ্য পূরণে সফলতা অর্জন করতে পেরেছে। 
 
 
মহান আল্লাহ হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নবীদের পবিত্র বৃক্ষ থেকে, আলোর প্রদীপ থেকে, সুউচ্চ আকাশের মত মর্যাদা ও মহত্ত্বের শীর্ষদেশ থেকে, পবিত্র মক্কা থেকে অন্ধকার-বিদারি প্রদীপ এবং প্রজ্ঞার প্রস্রবণ ও উৎস থেকে নির্বাচিত ও মনোনীত করেছেন। 
 
মহানবী যে সর্বোত্তম আদর্শ তা তুলে ধরতে গিয়ে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন, যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করে, তাদের জন্যে রসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। 
 
রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক, পারিবারিক, দাম্পত্য ও ব্যক্তিগত জীবন, যুদ্ধ-বিদ্যাসহ সব ধরনের শিক্ষা ও সামরিক প্রশিক্ষণসহ জীবনের এমন কোনো দিক নেই যে বিষয়ে মহানবী (সা) শ্রেষ্ঠ আদর্শ ছিলেন না। তাই মহানবীর অনুসারী বা মুসলমান হওয়ার দাবি করলে জীবনের সব ক্ষেত্রেই নবীজীকে শ্রেষ্ঠ আদর্শ বলে মানতে হবে। শান্তি ও সংকটকালীন সময়সহ ইসলাম ও মুসলমানদের ভবিষ্যত উন্নতি বা উন্নয়নের জন্য তাঁর সঠিক ও নিখুঁত পরিকল্পনা, দূরদৃষ্টি, বিচক্ষণতা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ইত্যাদি যুগ যুগ ধরে বিশেষজ্ঞ ও পণ্ডিতদের মহা-বিস্মিত করে এসেছে। ফলে আধুনিক যুগেও বিশ্ব-ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা হিসেবে মহানবীকে সর্বোচ্চ ও শীর্ষ আসন দিতে বাধ্য হয়েছেন মাইকেল এইচ হার্টের মত লেখক।  
 
দুঃখজনকভাবে কেউ কেউ প্রচার করে আসছেন যে মহানবী ভুল-ত্রুটির উর্ধ্বে ছিলেন না, বিশেষ করে ধর্মীয় বিষয়ের বাইরে দুনিয়াবি অনেক বিষয়ে তিনি সুদক্ষ ছিলেন না। ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনার সময় তারা বলেন যে অমুক অমুক ঘটনায় রাসুলের চেয়েও অন্য একজন সাহাবির মতামতকে আল্লাহ বেশি পছন্দ করেছেন বা  কখনও কখনও রাসুল ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অথবা ভুল পরামর্শ দিয়েছেন ওই বিষয়ে না জানার কারণে! কিংবা কোনো কোনো গুণের বিষয়ে তিনি কোনো কোনো সাহাবিকে নিজের চেয়েও বেশি উন্নত পর্যায়ের বলে মনে করতেন!  এসব ধারণা খুবই ভুল ও অন্যায্য। কারণ যিনি সর্বোত্তম আদর্শ তিনি সব ক্ষেত্রেই অন্যদের চেয়ে বেশি জ্ঞানী ও সর্বোত্তম সিদ্ধান্ত নেয়া বা দেয়ার ক্ষমতা রাখতেন এবং যে কোনো মহতী গুণে তিনি ছিলেন মানুষের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। আর তিনি জীবনে কখনও কোনো পাপ বা অন্যায় আচরণ করেননি। জগতবাসীকে সৎ ও পবিত্র করা ছিল বিশ্বনবীর দায়িত্ব। তাই তিনি যদি পবিত্র ও নিষ্পাপ না হন তিনি কিভাবে অন্যদের সব ধরনের পাপ ও পংকিলতা থেকে রক্ষা করবেন? এ জন্যই সুরা বাকারায় মহান আল্লাহ বলেছেন:
 
আমি পাঠিয়েছি তোমাদেরই মধ্য থেকে তোমাদের জন্যে একজন রসূল, যিনি তোমাদের কাছে আমার বাণীগুলো পাঠ করবেন এবং তোমাদের পবিত্র করবেন; আর তোমাদের শিক্ষা দেবেন কিতাব ও তাঁর তত্ত্বজ্ঞান এবং শিক্ষা দেবেন এমন বিষয় যা কখনো তোমরা জানতে না।-
বিশ্বনবী (সা) নিজেই বলেছেন, মানব-চরিত্রকে পূর্ণতা দেয়াই ছিল তাঁর রেসালাতের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, পরোপকার, সাহসিকতা ও বীরত্ব, বিনয়, নম্রতা, ভদ্রতা, সৌজন্যতা, ক্ষমাশীলতা, উদারতা ও অন্যের কল্যাণকামিতাসহ সর্বোত্তম চরিত্রের সবগুলো দিকেই তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। 
 
 
বিশ্বনবী (সা) ছিলেন উম্মি। এর অর্থ তিনি এমন এক ব্যক্তিত্ব যিনি পৃথিবীর কারো কাছে কিংবা কোন বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেননি। কিন্তু তিনি ছিলেন জ্ঞানের এক অফুরন্ত উৎস এবং ‘ইলমে লাদুন্নীর' তথা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আত্মিকভাবে আত্মস্থকারী জ্ঞানের অধিকারী। 
 
বিশ্বনবীকে চেনার ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর পর সবচেয়ে বেশি পারদর্শি ছিলেন আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী-আ। তিনি বিশ্বনবী-সা. সম্পর্কে বলেছেন, মহান আল্লাহ হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে সাক্ষী, সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শনকারী হিসেবে প্রেরণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন শৈশবে সমগ্র সৃষ্টিকুলের মধ্যে সর্বোত্তম এবং বয়স্কাবস্থায় তাদের মধ্যে সবচেয়ে ভদ্র। তিনি ছিলেন স্বভাব-চরিত্রে সকল পবিত্র ব্যক্তিত্বদের মধ্যে সবচেয়ে পবিত্র। তিনি ছিলেন স্থায়ী ও অবিরাম বৃষ্টি বর্ষণকারী মেঘমালার মত দানশীলদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ (দানশীল) অর্থাৎ যেসব মেঘ থেকে অবিরাম স্থায়ীভাবে বৃষ্টি বর্ষণ হতে থাকে সেসব মেঘের মত যারা স্থায়ীভাবে দান করে যায় তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠ। হযরত আলী আরও বলেছেন: হযরত মুহাম্মদ ছিলেন ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসকের মত যিনি রোগের উপশম দানকারী মলম প্রস্তত করে রাখতেন এবং ক্ষতস্থানে দাগ লাগানোর যন্ত্রকে উত্তপ্ত রাখতেন। যখনই অন্ধ হৃদয়, বধির কান ও বাকশক্তিহীন জিহ্বার চিকিৎসার প্রয়োজন হতো তখনই তিনি চিকিৎসার এসব উপায়-উপকরণ দক্ষতার সাথে ব্যবহার করতেন। তিনি অবহেলা-অমনোযোগ ও জটিলতার স্থানগুলোতে গভীরভাবে অনুসন্ধান করে সঠিক ঔষধ প্রয়োগ করতেন।
 
 
 
 
মহানবী সম্পর্কে হযরত আলী আরও বলেছেন: তিনি দুনিয়ার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছিলেন এবং একে অতি তুচ্ছ ও গুরুত্বহীন মনে করতেন। মহানবী (সা.) মাটিতে বসে আহার করতেন, ক্রীতদাসের মত বসতেন। নিজ হাতে নিজের চপ্পল সিলাই করতেন, কাপড়ে তালি দিতেন, জিন বা আসনবিহীন গাধার ওপর আরোহণ করতেন এবং (গাধার পিঠে যখন চড়তেন তখন) তিনি তাঁর পেছনে অন্য আরেক ব্যক্তিকেও বসাতেন। একবার তাঁর বাড়ীর দরজার ওপর চিত্রময় একটি পর্দা টাঙ্গানো হয়েছিল । তিনি তা দেখে তাঁর একজন স্ত্রীকে বলেছিলেন, “হে অমুক, পর্দাটি আমার (চোখের সামনে) থেকে সরিয়ে ফেল। কারণ যখনই আমি ঐটির দিকে তাকাই তখনই দুনিয়া ও এর চাকচিক্যের কথা আমার স্মরণ হয়। তিনি মন ও হৃদয় থেকে দুনিয়াকে বের করে দিয়েছিলেন এবং দৃষ্টি শক্তির সীমা থেকে দূর করেছিলেন। আর ঠিক একইভাবে যে ব্যক্তি কোন জিনিসকে অপছন্দ ও ঘৃণা করে আসলে সে ঐ জিনিসটির প্রতি দৃষ্টি দিতে এবং ঐ জিনিসটির আলোচনা ও স্মরণ করতেও ঘৃণাবোধ করে।
 
মনোবল ও দৃঢ়তার দিক থেকেও মহানবী ছিলেন সর্বকালের সেরা। রাসূল(সা.) কখনো কখনো এমন অবস্থায় পড়তেন যে, রাজনৈতিক ও সামাজিক সম্ভাবনার সব দরজাই তাঁর সামনে বন্ধ হয়ে যেত, পরিস্থিতি চলে যেত সম্পূর্ণ প্রতিকুলে এবং আশার কোন আলোই অবশিষ্ট থাকত না, কিন্তু সেসব মুহূর্তেও তিনি অবিচল থাকতেন, তাঁর ইচ্ছাশক্তি পর্বতের মতো অটল থাকতো। জিহাদের ময়দানেও তিনি ছিলেন সর্বকালের সেরা। রাসূলের(সা.) সাহসিকতা এ পর্যায়ের ছিল যে, স্বয়ং আলী (আ.) বলেছেন, যুদ্ধের ময়দানে কখনো কখনো পরিস্থিতি যখন আমাদের জন্য খুব কঠিন হয়ে পড়ত, তখন আমরা রাসূল (সা.)-এর কাছে আশ্রয় নিতাম। যদি কেউ মহানবীকে অসম্মান করত তিনি তার প্রতিশোধ নিতেন না। অন্যদের ভুল ও দুর্ব্যবহারকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতেন। তাদের অত্যাচার ও নিপীড়নের বিপরীতে ক্ষমা মহানুভবতা এবং বদান্যতা প্রকাশ করতেন। কুরাইশদের শত অত্যাচার ও নিপীড়ন সহ্য করে তিনি মক্কা বিজয়ের পর তাদেরকে ক্ষমা করেছিলেন এবং মুক্তি দিয়েছিলেন। 
 
মহানবী-সা. অসাধারণ দয়ালু ও ক্ষমাশীল হওয়া সত্ত্বেও কখনো কেউ ইসলামের সীমারেখা অতিক্রম করলে কোনরূপ নমনীয়তা দেখাতেন না। মহানবী যখন জানতে পারলেন “ফাতিমাহ মাখযুমী” চুরি করেছে তখন ওসমান বিন যাইদের মধ্যস্থতায় উত্থাপিত শাস্তি মাফের সুপারিশে কর্ণপাত করলেন না। তিনি বললেন:  পূর্ববর্তী গোষ্ঠীগুলোর ধ্বংস ও বিলুপ্তি এ কারণে হয়েছিল যে, তারা সমাজের উচ্চ শ্রেণীর লোকদের উপর শরীয়তের হুকুম জারী করত না। আল্লাহর শপথ! যদি আমার কন্যা “ফাতেমা যাহরা” এহেন কর্ম করত আমি তার হাত কেটে ফেলতাম। 
 
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ২৩ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে মানবজাতির কাছে উপহার দিয়ে গেছেন পবিত্র ইসলাম ধর্ম। এ ধর্ম একটি পরিপূর্ণ বা পূর্ণাঙ্গ ও চিরন্তন ধর্ম হিসেবে কোন বিশেষ জাতি বা গোত্রের জন্য সীমিত নয়। তাই ইসলামী ঐক্য রয়েছে এ ধর্মের রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মসূচীর শীর্ষে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে বিশ্বনবী (সা.) ঈমানের ছায়াতলে ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যের সংস্কৃতি উপহার দিয়েছিলেন। 
 
 
পবিত্র কুরআনের আয়াতের আলোকে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) মুসলিম সমাজকে আল্লাহর রশি শক্তভাবে আঁকড়ে ধরতে ও পরস্পর বিবাদ বা বিচ্ছিন্নতা পরিহার করতে বলেছেন। মুসলমানরা যতদিন তাঁর বাণী মান্য করেছিল ততদিন তারা শত্রুদের ওপর বিজয়ী হয়েছিল এবং এর ফলে ইসলাম ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে।  ইরানে ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের ফলেও বর্তমান বিশ্বে আবারো ইসলামী ঐক্য ও মুসলিম উম্মাহর পুনর্জাগরণ লক্ষ্যনীয়।
 
মহানবীর পবিত্র আহলে বাইত যুগে যুগে মানুষকে দিয়ে গেছেন সঠিক পথ ও মুক্তির সন্ধান তথা প্রকৃত ইসলাম ও কুরআনের প্রকৃত ব্যাখ্যা। আর এরই আলোকে প্রকৃত মুসলমানরা সঠিক ও জাল হাদিসের মধ্যে পার্থক্য করতে সক্ষম। মহানবীর হাদিস এবং তাঁর নির্দেশনাগুলোর যুগোপযোগী ব্যাখ্যা দিয়ে গেছেন তাঁরই বংশে জন্ম নেয়া পবিত্র ইমামগণ।  পবিত্র ইমামদের সংখ্যা হাদিসের আলোকে ১২ জন। তাঁদের মধ্যে মুসলমানরা কেবল ইমাম মাহদির প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব এখনও দেখতে পায়নি।  আর এ অবস্থায় মহানবীর আদর্শ অনুসরণের সর্বোত্তম পন্থা হল সবচেয়ে খোদাভীরু আলেম ও ইসলামী আইনবিদ তথা ইসলামী আইনের যুগোপযোগী ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম আলেমের অনুসরণ করা। কোনো কোনো হাদিসে বলা হয়েছে: আলেমরাই হচ্ছেন নবী-রাসুলদের উত্তরসূরি।
 
 
জাহেলিয়াতের কালো মেঘ সারা বিশ্বের ওপর যখন ছায়া মেলে রেখেছিল এবং অসৎ ও ঘৃণ্য কার্যকলাপ, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ-বিগ্রহ, লুটতরাজ ও সন্তান হত্যাসহ সব ধরনের নৈতিক গুণ যখন বিলুপ্ত হচ্ছিল তখনই মানব জাতির শ্রেষ্ঠ সৌভাগ্যরবির উদয় হয়। তার আবির্ভাব বিশ্ব-সভ্যতার সবচেয়ে বড় শুভ-লগ্ন। সমগ্র আরব উপদ্বীপ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শুভ জন্মোপলক্ষে আলোকোজ্জ্বল হয়। অনতিবিলম্বে এ নূরের বিচ্ছুরণে সমগ্র জগৎ আলোকোদ্ভাসিত হলো এবং সমগ্র বিশ্বে এক সুমহান মানব সভ্যতার ভিত্তিও নির্মিত হয়ে গেল।  
 
মহানবীর জন্মগ্রহণের মুহূর্তে সম্রাট খসরুর প্রাসাদের দ্বারমণ্ডপ ফেটে গিয়েছিল এবং এর কয়েকটি স্তম্ভ ধসে পড়েছিল। ফার্স প্রদেশের অগ্নি উপাসনালয়ের প্রজ্বলিত আগুন নিভে গিয়েছিল। ইরানের সাভেহ্ হ্রদ শুকিয়ে গিয়েছিল। পবিত্র মক্কার প্রতিমালয়গুলোতে রক্ষিত মূর্তি ও প্রতিমাগুলো মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। তাঁর দেহ থেকে নূর বের হয়ে তা আকাশের দিকে উত্থিত হয়েছিল যার রশ্মি মাইলের পর মাইল পথ আলোকিত করেছিল। সম্রাট আনুশিরওয়ান ও পুরোহিতরা অতি ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখেছিলেন।
 
এ সব ঘটনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল ঐ সব মানুষের অন্তরে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দেয়া ও মনোযোগ সৃষ্টি করা যারা মূর্তিপূজা, অন্যায় ও জুলুমের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল।
 
মহানবী (সা.) খতনাকৃত ও নাভি-কর্তিত অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তিনি বলেছিলেন,
 
الله أكبر و الحمد لله كثيرا سبحان الله بكرة و أصيلا
 
“আল্লাহ্ মহান, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করছি।” 
 
মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন: “হে আরব জাতি! (ইসলাম ধর্মে তোমাদের দীক্ষিত ও বিশ্বাস স্থাপনের পূর্বে) তোমরা জাহান্নামের আগুনের কাছে ছিলে। এরপর মহান আল্লাহ্ তোমাদেরকে (ইসলামের মাধ্যমে) মুক্তি দিয়েছেন।” (সূরা আলে ইমরান : ১০৩) ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের আগে আরব জাতির অবস্থা  প্রসঙ্গে হযরত আলী (আ) একটি ভাষণে বলেছেন : “মহান আল্লাহ্ হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে বিশ্বাসীদের ভয় প্রদর্শনকারী ঐশী প্রত্যাদেশ ও গ্রন্থের (আল কোরআন) বিশ্বস্ত আমানতদার হিসাবে প্রেরণ করেছেন। হে আরবরা! তখন তোমরা নিকৃষ্ট ধর্ম পালন ও নিকৃষ্টতম স্থানগুলোয় বসবাস করতে। তোমরা প্রস্তরময় স্থান এবং বধির (মারাত্মক বিষধর) সর্পকুলের মাঝে জীবনযাপন করতে (সেগুলো এমন বিষধর সাপ ছিল যা যে কোন প্রকার শব্দে পালিয়ে যেত না), তোমরা নোংরা লবণাক্ত-কর্দমাক্ত পানি পান করতে, কঠিন খাদ্য (খেজুর বীজের আটা এবং গুঁইসাপ) খেতে, একে অপরের রক্ত ঝরাতে এবং নিজ আত্মীয়-স্বজনদের থেকে দূরে থাকতে। তোমাদের মধ্যে মূর্তি ও প্রতিমাপূজার ব্যাপক প্রচলন ছিল। তোমরা কুকর্ম ও পাপ থেকে বিরত থাকতে না।”
 
 
হযরত আলী (আ.) আরব জাতি ও গোত্রসমূহের ধর্মীয় অবস্থার বর্ণনা করতে গিয়ে আরও বলেছেন :  “তখন (অন্ধকার যুগে) আরব জাতি নানা ধর্মের অনুসারী ছিল। তাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের বিদআত তথা ধর্ম বহির্ভূত প্রথা প্রচলিত ছিল এবং তারা অনেক ধর্মীয় গোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিল। একদল লোক মহান আল্লাহকে তাঁর সৃষ্টির সাথে তুলনা করত (এবং মহান আল্লাহর বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অস্তিত্বে বিশ্বাস করত)। কেউ কেউ মহান আল্লাহর নামের ক্ষেত্রেও হস্তক্ষেপ করত [যেমন মূর্তিপূজকরা লাত (لات) মূর্তির নাম ‘আল্লাহ্’ শব্দ থেকে এবং প্রতিমা উয্যার (عزّى) নাম নবী ‘উযাইর’ (عزير) থেকে নিয়েছিল]। আবার কোনো কোনো ব্যক্তি আল্লাহ্ ছাড়া অন্য সত্তার দিকে ইশারা-ইঙ্গিত করত; অতঃপর এদের সবাইকে আল্লাহ্ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে সৎ পথের সন্ধান দিলেন,সৎ পথে পরিচালনা করলেন এবং তাদেরকে পথভ্রষ্টতা ও অজ্ঞতা থেকে মুক্তি দিলেন।”
 
আরবের চিন্তাশীল শ্রেণীও গ্রহ আর চাঁদের উপাসনা করত। কিন্তু নিম্নশ্রেণীর লোক যারা আরবের সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল তারা তাদের গোত্রীয় ও পারিবারিক প্রতিমা ছাড়াও বছরের দিবসগুলোর সংখ্যা অনুসারে ৩৬০টি মূর্তির পূজা করত এবং প্রতিদিনের ঘটনাগুলোকে ঐ ৩৬০টি মূর্তির যে কোন একটির সাথে জড়িত বলে বিশ্বাস করত।
 
আরব সমাজে নারীদেরকে পণ্যের মতো কেনা-বেচা করা হতো। তারা সব ধরনের ব্যক্তিগত ও সামাজিক অধিকার, এমনকি উত্তরাধিকার থেকেও বঞ্চিত ছিল। প্রধানত দুর্ভিক্ষের ভয়ে এবং কখনো কখনো কলুষতা ও অশূচিতার ভয়ে আরবরা মেয়েদেরকে জন্মগ্রহণের পর পরই হত্যা করত।   পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে : যখন তাদের কোন এক ব্যক্তিকে কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণের সুসংবাদ দেয়া হতো তখন তার বর্ণ কালো হয়ে যেত এবং বাহ্যত সে যেন তার ক্রোধকে চাপা দিত। আর এই জঘন্য সংবাদ শোনার কারণে সে লজ্জায় তার সম্প্রদায়ের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াত। আর সে জানত না যে, সে কি অপমান ও লাঞ্ছনা সহকারে তার এ নবজাতক কন্যাসন্তান প্রতিপালন করবে, নাকি তাকে মাটির নিচে জীবন্ত পুঁতে ফেলবে? সত্যিই তাদের ফয়সালা কতই না জঘন্য!” 
 
আসলে বিশ্বনবীর আবির্ভাবের অনেক আগ থেকেই সারা বিশ্বই ভরে গিয়েছিল জুলুম, শোষণ, অনাচার,কুসংস্কার, অশান্তি, সংঘাত এবং নানা ধরনের পাপাচারে। এ অবস্থায় বিশ্বনবীর আবির্ভাব ছিল ঘন অমাবশ্যার রাতে সূর্যের প্রদীপ্ত উন্মেষের মতই অফুরন্ত কল্যাণ আর আলোর বন্যার ছড়াছড়ি এবং তার বাণী স্বাধীকারহারা মানুষের মনে জাগিয়ে তুলল অধিকার ফিরে পাওয়ার দূর্বার বাসনা। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তিনি সঞ্চালন করলেন সততা, সৌন্দর্য, ন্যায়বিচার, সুধর্ম এবং সব ধরনের সৎগুন ও নীতির জোয়ার। ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞানসহ বিশ্ব-সভ্যতার চরম উন্নতির পরিবেশ তৈরি হল। আজ  বহু অমুসলিম মনীষীও দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে স্বীকার করতে বাধ্য হন যে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হলেন মুহাম্মাদ (সা) এবং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এই মহামানবের আদর্শ অনুসরণের মধ্যেই রয়েছে বিশ্ববাসীর সার্বিক কল্যাণ ও মুক্তি।  কার্লাইল, বার্নার্ড ‘শ’র মত ব্যক্তিত্বরাও আভাস দিয়েছেন যে আগামী দিনের বিশ্ব হবে ইসলামের বিশ্ব এবং মুসলমানরাই থাকবে বিশ্ব-সভ্যতার নেতৃত্বে।
 
 
মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে মহানবী (সা) সম্পর্কে ভালোভাবে জানার সুযোগ দিন এবং তার প্রকৃত অনুসারী হওয়ার তৌফিক দিন। সবাইকে আবারও অজস্র সালাম ও শুভেচ্ছা জানিয়ে শেষ করছি আজকের এই আলোচনা।  পার্সটুডে
captcha